Amader Kantho- Bangla Online News Portal and Bangladeshi online news source for Game, Binodon, politics, national, international, lifestyle, sports, and many more factors.

ঢাকা, শনিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

Facebook Facebook Facebook Facebook

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে যা করেছিল জাপান

আমাদের কণ্ঠ প্রতিবেদক:
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১০:৪৫
ফাইল ছবি

শুধু ট্রাফিক সিগনালের সংখ্যা বাড়িয়েই জাপান সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনে। শুধু ট্রাফিক সিগনালের সংখ্যা বাড়িয়েই জাপান সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখনো চলছে। এমন আন্দোলন আগেও দেখেছে দেশ। বারবার দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে আইন অমান্য থেকে শুরু করে নানা বিষয় উঠে আসছে, কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। এই আন্দোলন চলাকালেই সড়কে প্রাণ ঝরে যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে। কারও যেন কিছুই করার নেই। আসলেই কি? উত্তর খুঁজতে জাপানের দিকে একটু তাকানো যাক।

বর্তমানে জাপানে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে সড়কে ৩ দশমিক ১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি ১ লাখে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ দশমিক ৩। ২০ বছর আগে ২০০০ সালে জাপানে এই সংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৪ এবং বাংলাদেশে ছিল ১০ দশমিক ৮। অর্থাৎ, গত ২০ বছরে জাপান তার সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার অবিশ্বাস্যরকমভাবে কমিয়ে আনলেও বাংলাদেশে ঘটছে ঠিক তার উল্টো চিত্র!

কেমন ছিল জাপানের অবস্থা

জাপানে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে সেখানে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। সড়কে ক্রমাগত মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধির ফলে গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে একে ‘ট্রাফিক যুদ্ধ’হিসেবে ঘোষণা করেন জাপানি পর্যবেক্ষকেরা এবং মৃত্যু কমাতে ধারাবাহিক কাজ শুরু করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাফিক অ্যান্ড সেফটি সায়েন্সেসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭০ সালে জাপানে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৭৬৫। পরে ১৯৮১ সালে এই সংখ্যা কমে ৮ হাজার ৭১৯-এ আসে। পরে এক দশকের মাথায় ১৯৯২ সালে মৃত্যুর সংখ্যা আবারও বাড়ে। সে সময় জাপান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। ফলে ২০০২ সালে মৃত্যু সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৩৬, ২০১৪ সালে হয় ৪ হাজার ১১৩ এবং ২০২০ সালে মাত্র ২ হাজার ৮৩৯-এ গিয়ে দাঁড়ায়।

মনে রাখতে হবে, ১৯৭০ সালে জাপানের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল মাত্র ২১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে হয় প্রায় ৫ লাখ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৫০ বছরে জাপানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ হাজার ২৫৮ শতাংশের বেশি। অর্থনীতির আকার বড় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যোগাযোগ এবং সেই সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা। এই হিসাবে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারত, কিন্তু হয়েছে উল্টো। এই একই সময়ে সড়কে মৃত্যুহার কমেছে।

জাপান পারল কীভাবে

ট্রাফিক যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা কমাতে জাপান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭০ সালে জাপানে যেখানে মাত্র ১৫ হাজার ট্রাফিক সিগনাল ছিল, ১৯৮০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯৫ হাজারে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ফলাফল আসে তদনগদ। শুধু ট্রাফিক সিগনালের সংখ্যা বাড়িয়েই দেশটি সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনে।

১৯৬৭ সালে জাপানে রাস্তা পারাপারের সেতুর সংখ্যা ছিল ১ হাজারেরও কম। ১৯৮০ সালের মধ্যে দেশটির সরকার ৯ হাজারেরও বেশি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে। ২০০০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে এই নির্মাণ। বাড়তে থাকে পদচারী সেতুর সংখ্যা। দেখা যায় ১৯৬৪-৬৭ সাল পর্যন্ত সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে—এমন এলাকার ১০০ মিটারের মধ্যে নির্মিত ৩১টি ফুটওভার ব্রিজ সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৮৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছিল।

ট্রাফিক সিগনাল ও ফুটওভার ব্রিজের পাশাপাশি প্রকৌশলীরা বাইপাস, রিং রোড ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে গ্রেড বিভাজনের ওপর নজর দেন, যেন রাস্তায় যানবাহন বৃদ্ধির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জাপানের ইনস্টিটিউট ফর ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেটা অ্যানালাইসিসের (আইটিএআরডিএ) ১৯৯০-৯৩ সালের সময়কালে করা এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাপানের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশ হয় দেশটির মহাসড়কগুলোর মাত্র ৯ শতাংশ স্থানে। পরে জাপান সরকার ১৯৯৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ৩ হাজার দুর্ঘটনার স্থান চিহ্নিত করে। সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা রোধে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

জাপান রোড ট্রান্সপোর্ট ভেহিক্যাল অ্যাক্টের অধীনে ১৯৭৫ সালে এক্সপ্রেসওয়েতে সব যাত্রীবাহী পরিবহনের সামনের সিটে সিট বেল্ট ব্যবহারের নিয়ম করে। প্রথমে না থাকলেও ১৯৮৫ সালে শাস্তির বিধানও করা হয়। ১৯৮৬ সালে সব রাস্তায় সিটবেল্ট এবং ২০০৭ সালে গাড়ির পেছনে বসা সব যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। জাপানের অটোমোবাইল ব্যবহারকারীদের ইউনিয়ন জাপান অটোমোটিভ ফেডারেশন (জেএএফ) বলছে, সিটবেল্ট পরিধানের আইন করায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক কমে আসে।

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া আন্দোলনগুলোয় বারবারই ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি উঠে এসেছে

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া আন্দোলনগুলোয় বারবারই ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি উঠে এসেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাপানের লাইসেন্স সিস্টেম

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে হওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গাড়িচালকদের লাইসেন্সের বিষয়টি বেশ জোরেশোরে উঠে এসেছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেশ সোচ্চার। বিষয়টি নিয়ে নানা সময়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দও কথা বলেছেন। দেখা যাক দুর্ঘটনা হ্রাসে সাফল্য পাওয়া জাপানে অবস্থাটা কেমন?

১৯৬৯ সালে জাপানে গাড়ির চালকদের জন্য পয়েন্ট সিস্টেম চালু করা হয়। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম উবারে যেমন চালকদের রেটিং দেওয়া যায়, ঠিক তেমন। জাপানে যদি কোনো চালক কোনো দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন কিংবা ট্রাফিক আইন ভাঙেন, তাহলে তাঁর নামে পয়েন্ট যুক্ত হয়। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট সেই চালকের নামে যুক্ত হলে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ, এই পয়েন্ট সিস্টেমের ফলে কোনো চালক লাইসেন্স পেয়ে গেলেই নিজের ইচ্ছামতো গাড়ি চালাতে পারেন না। লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁকে নিরাপদে গাড়ি চালাতেই হবে।

জাপানে যে কেউ চাইলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে না। ২০১৫ সাল থেকে লাইসেন্স পেতে একজন জাপানি নাগরিককে সরকারনির্ধারিত ড্রাইভিং স্কুলে ৩৪ ঘণ্টার ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও ২৬ ঘণ্টার তত্ত্বীয় প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ফলে চালক বিদ্যমান আইন-কানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা লাভ করেন। এ ছাড়া জাপানের স্কুলগুলোতে প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে সড়কে চলাচলের নিয়ম শেখানো হয়, যেন তাঁরা সড়কে চলাচলের সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে পারেন।

জরুরি চিকিৎসাসেবা

জাপানে সড়কে মৃত্যুহার কমার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে জরুরি চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া গেলে মৃত্যু অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালে জাপানে সড়ক দুর্ঘটনার পর মৃত্যুহার ছিল দশমিক শূন্য ২২ শতাংশ। জরুরি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার পর এই হার ২০১৩ সালে দশমিক শূন্য শূন্য ৭ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসাব্যবস্থা বিপুল পরিমাণ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম।

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া আন্দোলনগুলোয় বারবারই ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি উঠে এসেছে

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া আন্দোলনগুলোয় বারবারই ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি উঠে এসেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশের অবস্থা

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট ১১৪টি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩টি এলাকা দুর্ঘটনাপ্রবণ এবং ৫১টি এলাকাকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার সাতটি কারণও চিহ্নিত করেছে তারা। সরকার এই দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা নিরসনে কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, সে তথ্য অবশ্য পাওয়া যায় না তেমন।

ট্রাফিক লাইট, ফুটওভারব্রিজ কিংবা জনসচেতনতার কথা বাদ দিলে বাংলাদেশে লাইসেন্স সিস্টেমের কথা কম-বেশি সবারই জানা। জনশ্রুতি আছে, দালাল ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে ড্রাইভিং পরীক্ষা না দিয়েও সহজেই লাইসেন্স পাওয়া যায়। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হ্যাপীকে চাপা দেওয়া বাসে ঘটনার সময় চালকের আসনে ছিলেন চালকের সহকারী। সম্প্রতি নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেওয়া সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িও চালাচ্ছিলেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। অর্থাৎ, দুই ঘটনার মাঝে ১৬ বছর কেটে গেলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি খুব একটা।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানুষ যেখানে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতিদিনই মানুষকে বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে নিজের জীবনটাকে হাতে নিয়ে। আয়তনে জাপান বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ বড়। জাপানের মতো বাংলাদেশেও সবকিছু একইভাবে কার্যকর করা সম্ভব না হলেও সেখান থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে হয়তো সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। স্থানীয় বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, এর জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত প্রকল্প। একমাত্র সেই উপায়েই বাংলাদেশ পেতে পারে একটি নিরাপদ সড়কব্যবস্থা।

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জিয়াউল হক
চেয়ারম্যান: মিসেস নাজমা হক
ঠিকানা: শাঁহ আলী টাওয়ার (৩য় তলা)
৩৩, কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ ।

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি ।
©২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । আমাদেরকণ্ঠ২৪ ডট কম, জিয়া গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ।
কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নাম্বার CRW-24516