Amader Kantho- Bangla Online News Portal and Bangladeshi online news source for Game, Binodon, politics, national, international, lifestyle, sports, and many more factors.

ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Facebook Facebook Facebook Facebook

পত্রিকা পড়ার গল্প

শেখ হাসিনা:
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই, ২০২১, ১২:৪১
শেখ হাসিনা

আমি মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যে কয়টি পত্রিকা ছিল তা সরকারীকরণ করে সব সাংবাদিকের চাকরি সরকারিভাবে দেয়া হলো, বেতনও সরকারিভাবে পেতে শুরু করলেন তারা, আবার তারাই সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েও আব্বার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা শুরু করলেন। কেন?

ভোরে ঘুম থেকে উঠে একে একে সবাই জড়ো হতাম মায়ের শোবার ঘরে। হাতে চায়ের পেয়ালা, বিছানার ওপর ছড়ানো-ছিটানো খবরের কাগজ...একজনের পর আরেকজন, এক-একটা খবর পড়ছে আর অন্যরা মন দিয়ে শুনছে বা মতামত দিচ্ছে।

কখনও কখনও তর্কও চলছে- কাগজে কী লিখল বা কী বার্তা দিতে চাচ্ছে? যার যার চিন্তা থেকে মতামত দিয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে জমে উঠছে সকালের চায়ের আসর আর খবরের কাগজ পড়া।

আমাদের দিনটা এভাবেই শুরু হতো। অন্তত ঘণ্টা তিনেক এভাবেই চলত। আব্বা প্রস্তুত হয়ে যেতেন। আমরাও স্কুলের জন্য তৈরি হতাম। আব্বার অফিস এক মিনিটও এদিক-সেদিক হওয়ার জো নেই। সময়ানুবর্তিতা তার কাছে থেকেই আমরা পেয়েছি।

সংবাদপত্র পড়া ও বিভিন্ন মতামত দেয়া দেখে আব্বা একদিন বললেন : ‘বল তো, কে কোন খবরটা বেশি মন দিয়ে পড়ে?’

আমরা খুব হকচকিয়ে গেলাম। কেউ কোনো কথা বলতে পারি না। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা কাকা, জেনী সবাই সেখানে। এমনকি ছোট্ট রাসেলও আমাদের সঙ্গে। তবে সে পড়ে না, কাগজ কেড়ে নেয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে।

আমরা কিছু বলতে পারছি না দেখে আব্বা নিজেই বলে দিলেন- কে কোন খবরটা নিয়ে বেশি আগ্রহী। আমরা তো হতবাক! আব্বা এত খেয়াল করেন! মা সংবাদপত্রের ভেতরের ছোট ছোট খবরগুলো, বিশেষ করে সামাজিক বিষয় বেশি পড়তেন। আর কোথায় কী ঘটনা ঘটছে তা-ও দেখতেন। কামাল স্পোর্টসের খবর বেশি দেখত। জামালও মোটামুটি তা-ই। আমি সাহিত্যের পাতা, আর সিনেমার সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত হতাম। এভাবে একেকজনের একেক দিকে আগ্রহ।

খুব ছোটবেলা থেকেই কাগজের প্রতি রেহানার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। আব্বা ওকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চা খেতেন আর কাগজ পড়তেন। কাগজ দেখলেই রেহানা তা নিয়ে টানাটানি শুরু করত- নিজেই পড়বে এমনটা তার ভাব ছিল।

এরপর ধানমন্ডির বাড়িতে যখন আমরা চলে আসি, তখন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওরও কাগজ পড়া শুরু হয়। যখন একটু বড় হলো, তখন তো তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর পড়ার অভ্যাস হলো।

ওর দৃষ্টি থেকে কোনো খবরই এড়াত না, তা সিনেমার খবর হোক বা অন্য কিছু। আর ছোটদের পাতায় অনেক গল্প, কবিতা, কুইজ থাকত। রেহানা সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত।

এখন রেহানা লন্ডনে থাকে। সেখানে সে অনলাইনে নিয়মিত দেশের পত্র-পত্রিকা পড়ে। শুধু যে পড়ে তা-ই নয়, কোথাও কোনো মানুষের দুঃখ-কষ্টের খবর দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মেসেজ পাঠায়- অমুককে সাহায্য কর, এখানে কেন এ ঘটনা ঘটল, ব্যবস্থা নাও...।

উদাহরণ দিচ্ছি। এই তো করোনাভাইরাসের মহামারির সময়েরই ঘটনা। একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করে টাকা জমিয়েছিলেন ঘর বানাবেন বলে; কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ায় ওই ভিক্ষুক তার সব জমানো টাকা দান করে দেন করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য।

খবরের কাগজে এ মহানুভবতার খবর রেহানার মনকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়টি জানায়। আমরা তার জন্য ঘর তৈরি করে দিয়েছি। এভাবে এ পর্যন্ত অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি শুধু আমার ছোট্ট বোনটির উদার মানবিক গুণাবলির জন্য; ওর খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসের কারণে। সুদূর প্রবাসে থেকেও প্রতিনিয়ত সে দেশের মানুষের কথা ভাবে। পত্রিকার পাতা থেকে খবর সংগ্রহ করে মানুষের সেবা করে।

দুই.

আমার ও কামালের ছোটবেলা কেটেছে টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে। সেকালে ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় যেতে সময় লাগত দুই রাত এক দিন। অর্থাৎ সন্ধ্যার স্টিমারে চড়লে পরের দিন স্টিমারে কাটাতে হতো। এরপর শেষরাতে স্টিমার পাটগাতি স্টেশনে থামত। সেখান থেকে নৌকার দুই-আড়াই ঘণ্টার নদীপথ পেরিয়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে পৌঁছানো যেত।

কাজেই সেখানে কাগজ পৌঁছাত অনিয়মিতভাবে। তখন কাগজ বা পত্রিকা পড়া কাকে বলে তা শিখতে পারিনি। তবে একখানা কাগজ আসত আমাদের বাড়িতে। তা পড়ায় বড়দের যে প্রচণ্ড আগ্রহ তা দেখতাম।

ঢাকায় আমরা আসি ১৯৫৪ সালে। তখন রাজনৈতিক অনেক চড়াই-উতরাই চলছে। আব্বাকে তো আমরা পেতামই না। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আবার মন্ত্রিত্বও পেলেন। তিনি এত ব্যস্ত থাকতেন যে, গভীর রাতে ফিরতেন। আমরা তখন ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে উঠে আমি আর কামাল স্কুলে চলে যেতাম। মাঝেমধ্যে যখন দুপুরে খেতে আসতেন, তখন আব্বার দেখা পেতাম। ওই সময়টুকুই আমাদের কাছে ভীষণ মূল্যবান ছিল। আব্বার আদর-ভালোবাসা অল্প সময়ের জন্য পেলেও আমাদের জন্য ছিল তা অনেক পাওয়া।

বাংলার মানুষের জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার জীবনের সবটুকু সময়ই যেন বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল।

এরপরই কারাগারে বন্দি তিনি। বাইরে থাকলে মানুষের ভিড়ে আমরা খুব কমই আব্বাকে কাছে পেতাম। আর কারাগারে যখন বন্দি থাকতেন তখন ১৫ দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য দেখা পেতাম। এই তো ছিল আমাদের জীবন!

আমার মা আমাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন তার স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে। আর আমার দাদা-দাদি ও চাচা শেখ আবু নাসের- আমাদের সব আবদার তারা মেটাতেন। যা প্রয়োজন এনে দিতেন। আর আব্বার ফুফাতো ভাই খোকা কাকা সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকতেন।

আমাদের স্কুলে নেয়া, আব্বার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সরকার যে মামলা দিত তার জন্য আইনজীবীদের বাড়ি যাওয়া- সবই মা’র সঙ্গে সঙ্গে থেকে খোকা কাকা সহযোগিতা করতেন। তবে আমার মা পড়ালেখা করতে পছন্দ করতেন। আমার দাদা বাড়িতে নানা ধরনের পত্রিকা রাখতেন। আব্বার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দাদার পত্রিকা কেনা ও পড়ার কথা উল্লেখ আছে। তখন থেকেই আব্বার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। আর আমরা তার কাছ থেকেই পত্রিকা পড়তে শিখেছি।

পত্রিকার সঙ্গে আব্বার একটা আত্মিক যোগসূত্র ছিল। আব্বা যখন কলকাতায় পড়ালেখা করছিলেন, তখনই একটি পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জনাব হাশেম এ পত্রিকার তত্ত্বাবধান করতেন এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন।

পত্রিকাটির প্রচারের কাজে আব্বা যুক্ত ছিলেন। ‘মিল্লাত’ ও ‘ইত্তেহাদ’ নামে দুটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর সঙ্গেও আব্বা জড়িত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে ‘নতুন দিন’ নামে আরেকটি পত্রিকার সঙ্গে আব্বা সম্পৃক্ত হন। কবি লুৎফর রহমান জুলফিকার ছিলেন এর সম্পাদক।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আর্থিক সহায়তায় ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এ পত্রিকার সঙ্গেও আব্বা সংযুক্ত ছিলেন এবং এতে কাজ করেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর আব্বা ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সংগঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি করে আইয়ুব খান। আব্বা গ্রেপ্তার হন। ১৯৬০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।

মুক্তি পেয়ে তিনি আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। কারণ, এ সময় তার রাজনীতি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এমনকি ঢাকার বাইরে যেতে গেলেও থানায় খবর দিয়ে যেতে হতো, গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়ে যেতে হতো। তবে আমাদের জন্য সে সময়টা আব্বাকে কাছে পাওয়ার এক বিরল সুযোগ এনে দেয়।

খুব ভোরে উঠে আব্বার সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বের হতাম। আমরা তখন সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে থাকতাম। রমনা পার্ক তখন তৈরি হচ্ছে। ৭৬ নম্বর সেগুনবাগিচার সেই বাসা থেকে হেঁটে পার্কে যেতাম। সেখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা ছিল। কয়েকটি হরিণ, ময়ূর, পাখিসহ কিছু জীবজন্তু ছিল তাতে।

বাসায় ফিরে এসে আব্বা চা ও খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। মা ও আব্বা মিলে কাগজ পড়তেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।

ইত্তেফাক পত্রিকার ‘কচিকাঁচার আসর’ নামে ছোটদের একটা অংশ প্রতি সপ্তাহে বের হতো। সেখানে জালাল আহমেদ নামে একজন ‘জাপানের চিঠি’ বলে একটা লেখা লিখতেন। ধাঁধার আসর ছিল। আমি ধাঁধার আসরে মাঝেমধ্যে ধাঁধার জবাব দিতাম। কখনও কখনও মেলাতেও পারতাম।

পত্রিকাগুলোতে তখন সাহিত্যের পাতা থাকত। বারান্দায় বসে চা ও কাগজ পড়া প্রতিদিনের কাজ ছিল। আমার মা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজ পড়তেন। দুপুরে খাবার খেয়ে মা পত্রিকা ও ডাকবাক্সের চিঠিপত্র নিয়ে বসতেন।

আমাদের বাসায় নিয়মিত ‘বেগম’ পত্রিকা রাখা হতো। ন্যাশনাল ‘জিওগ্রাফি’, ‘লাইফ’ এবং ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’- কোনোটা সাপ্তাহিক, কোনোটা মাসিক আবার কোনোটাবা ত্রৈমাসিক- এ পত্রিকাগুলো রাখা হতো। ‘সমকাল’ সাহিত্য পত্রিকাও বাসায় রাখা হতো। মা খুব পছন্দ করতেন। ‘বেগম’ ও ‘সমকাল’- এ দুটোর লেখা মায়ের খুব পছন্দ ছিল।

সে সময়ে সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করলেন আব্বা। সেগুনবাগিচায় একটা জায়গা নিয়ে সেখানে একটা ট্রেডল মেশিন বসানো হলো, যেখান থেকে ‘বাংলার বাণী’ প্রকাশিত হতো।

মণি ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়তেন। তাকেই কাগজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সালে আব্বা আবার গ্রেপ্তার হন। আমরা তখন ধানমন্ডির বাড়িতে চলে এসেছি। কারাগারে আব্বা যখন বন্দি থাকতেন, বাইরের খবর পাওয়ার একমাত্র উপায় থাকত খবরের কাগজ। কিন্তু যে পত্রিকা দেয়া হতো সেগুলো সেন্সর করে দেয়া হতো।

বন্দি থাকাবস্থায় পত্রিকা পড়ার যে আগ্রহ তা আপনারা যদি আমার আব্বার লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়েন তখনই বুঝতে পারবেন। একজন বন্দির জীবনে, আর যদি সে হয় রাজবন্দি, তার জন্য পত্রিকা কত গুরুত্বপূর্ণ- তাতে প্রকাশ পেয়েছে।

যদিও বাইরের খবরাখবর পেতে আব্বার খুব বেশি বেগ পেতে হতো না, কারণ জেলের ভেতরে যারা কাজ করতেন বা অন্য বন্দিরা থাকতেন, তাদের কাছ থেকেই অনায়াসে তিনি খবরগুলো পেতেন।

আমার মা যখন সাক্ষাৎ করতে যেতেন, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি আব্বাকে অবহিত করতেন। আর আব্বা যেসব দিকনির্দেশনা দিতেন, সেগুলো তিনি দলের নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। বিশেষ করে ছয় দফা দেয়ার পর যে আন্দোলনটা গড়ে ওঠে, তার সবটুকু কৃতিত্বই আমার মায়ের। তার ছিল প্রখর স্মরণশক্তি।

বন্দি থাকাবস্থায় পত্রিকা যে কত বড় সহায়ক সাথি তা আমি নিজেও জানি। ২০০৭-০৮ সময়ে যখন বন্দি ছিলাম, আমি নিজের টাকায় ৪টি পত্রিকা কিনতাম। তবে নিজের পছন্দমতো কাগজ নেয়া যেত না। সরকার ৪টি পত্রিকার নাম দিয়েছিল, তাই নিতাম। কিছু খবর তো পাওয়া যেত।

তিন.

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে আমার আব্বা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন। সেই সঙ্গে আমার মা, তিন ভাইসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়।

আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলাম। সব হারিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে রিফিউজি হিসেবে যখন পরাশ্রয়ে জীবযাপন করি, তখনও পত্রিকা জোগাড় করেছি এবং নিয়মিত পত্রিকা পড়েছি।

১৯৮০ সালে দিল্লি থেকে লন্ডন গিয়েছিলাম। রেহানার সঙ্গে ছিলাম বেশ কিছুদিন। তখন যে পাড়ায় আমরা থাকতাম, ওই পাড়ার ৮-১০ জন ছেলেমেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতাম। ছুটি হলে সবাইকে নিয়ে আবার ঘরে পৌঁছে দিতাম।

বাচ্চাপ্রতি এক পাউন্ড করে মজুরি পেতাম। ওই টাকা থেকে সর্বপ্রথম যে খরচটা আমি প্রতিদিন করতাম, তা হলো কর্নারশপ থেকে একটি পত্রিকা কেনা। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফেরার সময় পত্রিকা, রুটি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসায় ফিরতাম। তখন একটি পত্রিকা হাতে না নিলে মনে হতো সব দিনটাই যেন ‘পানসে’ হয়ে গেছে।

সব সময়ই আব্বা ও মায়ের কথা চিন্তা করি। তারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভাবতে শিখিয়েছেন। মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগ্রত করেছেন। সাদাসিধে জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে উন্নততর সুচিন্তা করতে শিখিয়েছেন।

মানবপ্রেম ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করেছেন। সে আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছিলাম বলেই আজ দেশসেবার মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হচ্ছি। প্রতিদিনের রাষ্ট্র পরিচালনায় মানবকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা নিতে পারছি এবং তা বাস্তবায়ন করছি। যার সুফল বাংলাদেশের মানুষ ভোগ করছে।

সমালোচনা-আলোচনা রাজনৈতিক জীবনে থাকবেই। কিন্তু সততা-নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করলে, নিজের আত্মবিশ্বাস থেকে সিদ্ধান্ত নিলে, সে কাজের শুভ ফলটা মানুষের কাছে পৌঁছবেই।

গণমাধ্যম সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। আমি সরকার গঠন করার পর সব সরকারি পত্রিকা ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিই। যদিও সরকারীকরণের বিরুদ্ধে যারা ছিলেন এবং সরকারীকরণ নিয়ে যারা খুবই সমালোচনা করতেন, তারাই আবার যখন বেসরকারীকরণ করলাম, তখন আমার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন। আন্দোলন, অনশনও হয়েছে।

আমি মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যে কয়টি পত্রিকা ছিল তা সরকারীকরণ করে সব সাংবাদিকের চাকরি সরকারিভাবে দেয়া হলো, বেতনও সরকারিভাবে পেতে শুরু করলেন তারা, আবার তারাই সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েও আব্বার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা শুরু করলেন। কেন?

আবার আমি যখন সব ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিলাম, সরকারি পত্রিকা তখন কেন বেসরকারি করছি তা নিয়ে সমালোচনা, আন্দোলন, অনশন সবই হলো। কেন? এর উত্তর কেউ দেবেন না, আমি জানি।

১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ছিল। সেগুলোরও নিয়ন্ত্রণ হতো বিশেষ জায়গা থেকে। সরকারি মালিকানায় রেডিও, টেলিভিশন। বেসরকারি খাতে কোনো টেলিভিশন, রেডিও চ্যানেল ছিল না।

আমি উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করে দিলাম। এ ক্ষেত্রে আমার দুটি লক্ষ্য ছিল- একটি হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, আরেকটি হলো আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ- বর্তমান যুগের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতি-শিল্পের সম্মিলন ঘটানো। যাতে আধুনিকতা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়, তৃণমূলের মানুষ এর সুফল ভোগ করতে পারে।

২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিলাম। ডিজিটাল ডিভাইস আমাদের কর্মজীবনে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে সহায়তা করছে। সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার সুযোগ পাচ্ছি।

১৯৯৬ সালেই মোবাইল ফোন বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আজ সবার হাতে মোবাইল ফোন।

বাংলাদেশে সিনেমা শিল্পের শুরু হয়েছিল আব্বার হাত ধরে। এ শিল্পকে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন করে বাংলাদেশের মানুষের চিত্তবিনোদনের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। আবার সার্বিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনেও ভূমিকা রাখতে পারে এ শিল্প।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে আমরা এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিন যাপন করছি। আমি আশাবাদী এ কালোমেঘ শিগগিরই কেটে যাবে, উদয় হবে আলোকোজ্জ্বল নতুন সূর্যের। সবার জীবন সফল হোক, সুন্দর হোক। সবাই সুস্থ থাকুন, এ কামনা করি।

লেখক: প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
 

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জিয়াউল হক
চেয়ারম্যান: মিসেস নাজমা হক
ঠিকানা: শাঁহ আলী টাওয়ার (৩য় তলা)
৩৩, কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ ।

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি ।
©২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । আমাদেরকণ্ঠ২৪ ডট কম, জিয়া গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ।
কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নাম্বার CRW-24516